ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে বাংলার দেওয়ানি লাভ করে | দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব ও ফলাফল গুলি আলোচনা করো

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে বাংলার দেওয়ানি লাভ করে | দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব ও ফলাফল গুলি আলোচনা করো

কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পটভূমি :
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানির মতে ভারতে এসেছিল বাণিজ্য করতে। কিন্তু পরপর পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধ জয়ের পর কোম্পানি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ সে সচেষ্ট হয়। এই লক্ষ্যে কোম্পানি আইনানুগ স্বীকৃতি লাভের জন্য উদ্যোগ নেই।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ




১) নজম-উদ্দৌলার সঙ্গে চুক্তি : 
মীরজাফর এর মৃত্যুর পর তার পুত্র বাংলার নবাব নজম উদ দৌলার সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির জটি
 1765 খ্রিস্টাব্দের কুড়ি ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর দ্বারা কোম্পানি সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
আরো পড়ুন-:

২) অযোধ্যার নবাব এর সঙ্গে সন্ধি :
অযোধ্যার শাসক সুজাউদ্দৌলা সঙ্গে কোম্পানি এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি স্বাক্ষরিত করে 1765 খ্রিস্টাব্দে। যার মাধ্যমে নিজের আধিপত্য আরো বৃদ্ধি করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই সন্ধিতে স্থির হয়-
A) সুজাউদ্দৌলা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানিকে 50 লক্ষ টাকা এবং কারা ও এলাহাবাদ প্রদেশ দুটি প্রদান করবে, বিনিময়ে তাকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
B) অযোধ্যা কোন শত্রুরাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হলে কোম্পানি তাকে রক্ষা করবে।

৩) শাহ আলমের সঙ্গে সন্ধি :
বক্সারের যুদ্ধের পর দিল্লির মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে কোম্পানি এলাহাবাদের সন্ধি স্বাক্ষরিত 1765 খ্রিস্টাব্দে। এই সন্ধি অনুযায়ী কোম্পানি কারা ও এলাহাবাদ প্রদেশ দুটি এবং বার্ষিক 26 লক্ষ টাকা কর সম্রাটকে প্রদানের বিনিময় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও  উড়িষ্যার দেওয়ানী বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে।

৪) নজম উদ্দৌলার সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি  :
কোম্পানির পক্ষে রবার্ট ক্লাইভ বাংলার নবাব নজম উদ্দৌলার সঙ্গে পুনরায় এক চুক্তি করে 1765 খ্রিস্টাব্দের 30 শে সেপ্টেম্বর। এই চুক্তিতে ঠিক হয় যে, এখন থেকে বাংলার শাসন কাজ বা নিজামত পরিচালনার জন্য বাংলার দেওয়ান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব কে বার্ষিক 53 লক্ষ টাকা দেবে। এরপর থেকে নবাব কোম্পানির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় কোম্পানির নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব বা ফলাফল:
👉রাজনৈতিক গুরুত্ব
১) কোম্পানির আইনগত স্বীকৃতি লাভ:
দেওয়ানি লাভ তারা কোম্পানির ক্ষমতা আইনগত স্বীকৃতি পায়। বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার ওপর কোম্পানির সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। কোম্পানি রাজ্যশাসনের বৈধ অংশীদারের পরিণত হয়। বস্তুত বক্সারের যুদ্ধে অর্জিত ক্ষমতা দেওয়ানি লাভের সঙ্গে আইনগত বৈধতা পায়।

২) উপ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা:
কোম্পানি বাংলার অর্থ ও অস্ত্র অর্থাৎ সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিজের হাতে রেখে নিজামত ও দেশ শাসনের দায়িত্ব নবাবের হাতে তুলে দেয়। ফলে কোম্পানি পাই 'দায়িত্বহীন ক্ষমতা', আর নবাব পান 'ক্ষমতাহীন দায়িত্ব'। ইতিহাসবিদ পি.জে মার্শাল এই ব্যবস্থাকে উপ সাম্রাজ্যবাদ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে,"1765 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির দেওয়ানি লাভকে বাংলায় মোগল যুগ ও ব্রিটিশ যুগের বিভাজিকা বলা হয়।"

৩) দ্বৈত শাসনের সূচনা:
দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানির বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু করে। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী নবাবকে দেওয়া হয় নিজামতের দায়িত্ব। আর কোম্পানির হাতে থাকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব। কোম্পানি সরাসরি রাজস্ব আদায় না করে রাজস্ব আদায়ের জন্য বাংলায় রেজা খাঁ ও বিহারে সিতাব রায় কে নিযুক্ত করে। তারা আবার বিভিন্ন জেলায় রাজস্বের পরিমাণ ঠিক করে চুক্তি অনুযায়ী কিছু লোককে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়। এইভাবে আমলদারি ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। আমিলরা আবার জেলাগুলিতে জেজে জমিদার সর্বোচ্চ রাজস্ব দিতে স্বীকৃত হত, তাদের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়। ফলে জমিদাররা ইজারাদারে পরিণত হয়। তারা যথেষ্ট ভাবে অত্যাচার চালিয়ে রাজস্ব আদায় করতে থাকে। অন্যদিকে নবাবের কোন ক্ষমতা না থাকায় আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। ফলে বাংলার জনজীবনে দেখাদেই অরাজকতা। আর এর পরিণতি হিসেবে সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়। গ্রাম্য জীবন ও তার কৃষি অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

👉অর্থনৈতিক গুরুত্ব
১) দেশীয় আর্থিক সম্পদের অবক্ষয়:
রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব কোম্পানির হস্তগত হওয়ার ফলে বাংলার নবাব কার্যত ব্রিটিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে নবাবের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লোপ পায়। দেওয়ানি লাভের আগে ইংরেজরা ইংল্যান্ড থেকে শোনা রুপোর মুদ্রা যা বুলিয়ান নামে পরিচিত এসব আমদানি করে এদেশে পণ্য ক্রয় করত। কিন্তু রাজস্বের মাধ্যমে অর্থ লাভের পর থেকে তারা বুলিয়ান আমদানি বন্ধ করে দেয় এবং এদেশের অর্থে বাণিজ্য চালাতে থাকে। ফলে ভারতের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়।

২) ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমি রচনা :
দেওয়ানি লাভের ফলে কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বাংলায় শুল্ক হীন অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ পায়। কোম্পানি বাংলার রাজস্বের দাবি বহুগুণ বাড়িয়ে দেই। কোম্পানির অর্থের লালসা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। নায়েব দেওয়ান রেজা খাঁ কোম্পানিকে সতর্ক করে বলেন, এই হারে কর আদায় করা হলে গ্রামবাংলায় বিপর্যয় নেমে আসবে। কোম্পানির কর্তৃপক্ষ এই সাবধান বাণীতে কর্ণপাত না করলে 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের' পটভূমি রচিত হয়।

৩) সম্পদের নির্গমন: 
কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পর বাংলা থেকে ব্যাপকভাবে সম্পদের নির্গমন হতে থাকে। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা অবাধ শুল্ক হীন বাণিজ্য দ্বারা বঙ্গলক্ষীর ভান্ডার লুট করতে থাকে। আর এই লুণ্ঠিত অর্থ ইংল্যান্ডে চলে যায়। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, বাংলা থেকে পাঠানো এই সম্পদের সাহায্যে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের মূলধন সরবরাহ হয়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন