ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর কার্যাবলী ও সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো? Functions and limitations of the YoungBengal group

ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর কার্যাবলী ও সীমাবদ্ধতা: 

ভূমিকা: উনিশ শতকে ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে যে সকল ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। 

তিনি কলকাতার এন্টালী অঞ্চলে 1809 খ্রিস্টাব্দে এক ইঙ্গ পর্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 

Do you want to earn money online follow this blog.

ডেভিড  ড্রামন্ডের 'ধর্মতলা একাডেমী'তে শিক্ষালাভ করার পর মাত্র 17 বছর বয়সেই হিন্দু কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। 

অল্পদিনের মধ্যেই তার মধ্যে প্রবল যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ জেগে ওঠে। তিনি ছাত্র দের অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে সত্যসন্ধানী হওয়ার পরামর্শ দিতেন। 

অধ্যাপক শিবরাম শাস্ত্রী তার 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ'গ্রন্থে লিখেছেন,"চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে, তেমনি তিনিও বালক দিকে আকর্ষণ করিতেন ।"

 তার নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে একদল শিক্ষার্থী হিন্দুধর্ম ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে যা নব্য বঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত।

ইয়ং বেঙ্গল



More ARTICAL

*ডিরোজিওর আদর্শ: ডিরোজিও যুক্তি দিয়ে বিচার করে সব কিছুকে গ্রহণ করার পরামর্শ তার ছাত্রদেরকে দিতেন। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ও দেশপ্রেম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন। তার প্রেরণায় ছাত্ররা মিল, বার্কলে, লক, বেন্থাম, হিউম, পেইন, রুশো প্রমুখের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে।

ডিরোজিওর সংস্কার কর্মসূচি: তরুণ অধ্যাপক ডিরোজিও হিন্দু সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার উদ্দেশ্যে তার ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম ও যুক্তিবাদ জাগিয়ে তোলে তার পদক্ষেপ গুলি হল -

১) অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন :  ডিরোজিও তার ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা জাগানোর জন্য 1828 খ্রিস্টাব্দে 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' নামক একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন
এখানে তার ছাত্ররা সমবেতভাবে ধর্ম ও সমাজ সম্পর্কে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মতামত প্রকাশ করত। জাতিভেদ প্রথা, মূর্তি পূজা, সতীদাহ প্রথা, অস্পৃশ্যতা ও প্রচলিত হিন্দু ধর্ম ছিল তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। এই প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র ছিল 'এথেনিয়াম।'

২) পত্রিকা প্রকাশ: ডিরোজিও তার এবং ছাত্ররা মিলে  1830 সালে 'পার্থেনন' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এতে নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি আলোচনা হতো। এছাড়াও তিনি ক্যালাইডোস্কোপ, হেসপেরাস, ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট পত্রিকা প্রকাশ করেন।

৩) হিন্দু ধর্মের রক্ষনশীলতার বিরুদ্ধে আক্রমণ:
ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতা কে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। তারা ব্রাহ্মণদের উপবীত ছিড়ে ফেলত, নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করত। পুরোহিতদের লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলতো,"আমরা গো মাংস খায় গো"। কালীঘাটের মন্দিরে কালিমাতার সামনে গিয়ে বলতো,"গুড মর্নিং ম্যাডাম"। গঙ্গাজল কে তারা মানতে না।

৪) দেশপ্রেম ও স্বদেশপ্রীতি: ডিরোজিও তার ছাত্রদের মধ্যে গভীর দেশ প্রেম জাগিয়ে তোলে। তার লেখা দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল 'ফকির অব জঙ্গিরা' ও 'টু ইন্ডিয়া মাই নেটিভ ল্যান্ড'।

৫) সামাজিক সংস্কার:ডিরোজিওর চিন্তাধারা ও যুক্তিবাদ তাদের ছাত্র দের অভিভাবককে চিন্তিত করে তোলে। প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীল হিন্দুদের চাপে তাকে হিন্দু কলেজ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। 1832 সালে 22 বছর বয়সে মারা যান।

৬) ডিরোজিওর মৃত্যু পরবর্তী নব্য বঙ্গ আন্দোলন :  ডিরোজিও মারা যাওয়ার পর তার আদর্শের মৃত্যু হয়নি। তার অনুগামীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রামতনু লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, কিশোরী চাঁদ মিত্র প্রমূখ।

) ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর পত্রিকা প্রকাশ:  ইয়ং বঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা এনকোয়েরার, জ্ঞানেশ্বর, হিন্দু পাইওনিয়ার পত্রিকা প্রকাশ করে।

৮)  সংগঠন প্রতিষ্ঠা : ডিরোজিওর অনুগামীরা 'জ্ঞানোপারজনী সভা' প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও 1843 সালে বেঙ্গল ব্রিটিশ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তারা দাসপ্রথা, নারী নির্যাতন, বেগার খাটানো, মরিশাসে ভারতীয় কুলি প্রেরণ, নারী পুরুষ সমতা প্রভৃতির দাবি জানায়।

নব্যবঙ্গ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ : ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন একাধিক কারণে ব্যর্থ হয়। এগুলি হল-
1) শহর কেন্দ্রিকতা : নব্য বঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের কোন যোগাযোগ ছিল না। কিছু শহরের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল। অনিল শীল এর মতে,'তারা গজদন্ত মিনারে বাস করত'।

 2) নেতিবাচক কর্মসূচি : ইয়ংবেঙ্গল সদস্যদের কোন সংগঠন মূলক কর্মসূচি ছিল না। তাদের সব চিন্তায় ছিল নেতিবাচক।

3) এলিটিস্ট আন্দোলন : নব্য বঙ্গ আন্দোলন ছিল এক প্রকার এলিটিস্ট আন্দোলন। দরিদ্রদের প্রতি তাদের মনোভাব ছিল উদাসীন।

4) মুসলিম যোগাযোগের অভাব : তাদের সব কার্যকলাপ ছিল হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করে তাই মুসলিমদের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র ছিলনা।

মূল্যায়ন : ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের বিরুদ্ধে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। ডেভিড কফ তাদের, "ভ্রান্ত পুথি পড়া বুদ্ধিজীবী বলেছেন"। তা সত্বেও তাদের কার্যকলাপ এর মধ্যে নবজাগরণের ঊষালগ্ন বলেছেন।
 young Bengal.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ